13 May 2024, 02:00 am

দুর্গম পাহাড়ে গিয়ে জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের চিকিৎসা দিতেন সদ্য এমবিবিএস পাস শাকির

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : গত ১৩ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা থেকে হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হওয়া আবরুর হক আবরারকে (১৮) গ্রেফতার করে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)।

তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে, পরদিন রামপুরা এলাকা থেকে সদ্য এমবিবিএস পাস করা শাকির বিন ওয়ালী নামে এক চিকিৎসককে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। শাকির বিন ওয়ালী হলেন নতুন জঙ্গি সংগঠনের দাওয়া বিভাগের প্রধান।

সিটিটিসি জানায়, চিকিৎসক শাকির বিন ওয়ালী জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সদস্য। তিনি ঢাকা থেকে দুর্গম পাহাড়ে গিয়ে আহত ঘরছাড়া তরুণদের চিকিৎসা দিতেন।

রাজধানীর ডেমরা এলাকা থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠনের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে সিটিটিসি। তারা হলেন নাটোরের মো. আব্দুল্লাহ (২২), কুমিল্লার চান্দিনা মো. তাজুল ইসলাম (৩৩), নারায়ণগঞ্জের মো. জিয়াউদ্দিন (৩৭), মাদারীপুরের মো. হাবিবুল্লাহ (১৯) ও নারায়ণগঞ্জের মো. মাহামুদুল হাসান (১৮)। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে তিনটি মোবাইল, ফতুওয়া সংক্রান্ত ১২ পাতার কাগজ জব্দ করা হয়।

বৃহস্পতিবার (২৭ অক্টোবর) দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান।

তিনি বলেন, গ্রেফতাররা বিভিন্ন সময় জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে হিজরতের উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছিলেন। গ্রেফতার আব্দুল্লাহ আনসার হাউজ (সেইফ হাউজ) পরিচালনা করতেন। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠনের যেসব সদস্য হিজরতের উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে যেতেন তাদের এই আনসার হাউজে জায়গা দিতেন তিনি। পরে সেই আনসার হাউজ থেকে আব্দুল্লাহ নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য পার্বত্য অঞ্চলে পাঠাতেন।

এর মধ্য রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে তরুণদের রিসিভ করে আনসার হাউজে নিয়ে যেতেন গ্রেফতার তাজুল ও হাবিবুল্লাহ।

সম্প্রতি দুর্গম পাহাড়ে বাড়িছাড়া কিছু তরুণ জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’কে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ (কেএনএফ) নামে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। কয়েক মাস আগে ঘরছাড়া বেশ কয়েকজন তরুণ পাহাড়ে গিয়ে কেএনএফ’র কাছে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে বলে জানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

সিটিটিসি প্রধান বলেন, গত আগস্ট মাসে কুমিল্লা থেকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে একযোগে সাত তরুণ ঘর ছেড়ে হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হন। বিষয়টি দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। পরে এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করে সিটিটিসি। তদন্তর একপর্যায়ে এর আগে আবরুর হক আবরার নামে এক তরুণকে গ্রেফতার করা হয়।

আবরারকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, হিজরতের উদ্দেশ্যে তিনি ঘর থেকে বের হয়েছিলেন। আবরারকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে এসেছিলেন চিকিৎসক শাকির বিন ওয়ালী।

এই শাকির বিন ওয়ালী নতুন জঙ্গি সংগঠনের দাওয়া বিভাগের প্রধান বলে জানান সিটিটিসি প্রধান। তিনি কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস পাস করেন।

প্রতি মাসেই প্রশিক্ষণ শিবিরে যেতেন শাকির : প্রতি মাসে একবার বান্দরবানে গিয়ে নতুন জঙ্গি সংগঠনটির প্রশিক্ষণ শিবিরে যেতেন
শাকির বিন ওয়ালী। সেখানে তাদের কোনো সদস্য অসুস্থ হলে দিতেন চিকিৎসা। আবার তিনি যখন ঢাকায় থাকতেন তখন নতুন জঙ্গি সংগঠনটির প্রধান শামিন মাহফুজ ওরফে স্যারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতেন। ফোনে সদস্যদের অসুস্থতার লক্ষণ শুনে ব্যবস্থাপত্র পাঠাতেন চিকিৎসক শাকির।

এছাড়া জঙ্গি সংগঠনটির সঙ্গে প্রশিক্ষণ শিবিরে থাকা পাহাড়ি সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি-চিনের সদস্যরা আহত হলেও সেখানে গিয়ে চিকিৎসা দিতেন শাকির বিন ওয়ালী।

সিটিটিসির প্রধান মো. আসাদুজ্জামান আরও বলেন, চিকিৎসক শাকিরকে জিজ্ঞাসাবাদে আমরা একজনের নাম পেয়েছি। তার নাম হচ্ছে মহসিন ওরফে রিয়েল। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে নতুন জঙ্গি সংগঠনটির একজন শীর্ষ নেতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। দেশের একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে উচ্চ বেতনে চাকরিও করতেন তিনি।

চিকিৎসক শাকির গত দুদিন আগে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানান সিটিটিসি প্রধান। তিনি বলেন, নতুন সংগঠনটির প্রথম আমির মাইনুল ইসলাম ওরফে রক্সি। ২০২১ সালের আগ পর্যন্ত রক্সি ছিলেন এই সংগঠনের আমির। ২০২১ সালে রক্সিকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। রক্সি আমাদের জানায়, এই সংগঠনের মাস্টারমাইন্ড শামিন মাহফুজ ওরফে স্যার। ২০১৪ সালে শামিন মাহফুজ ওরফে স্যারকে গ্রেফতার করে ডিবি।

এর আগে ২০১৫ সালে রক্সি একবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। রক্সি ও শামিন যখন একসঙ্গে জেলখানায় ছিলেন তখন তারা সেখানে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আবু সাঈদের সংস্পর্শে আসেন। আবু সাইদের সংস্পর্শে এসে তারা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। জেলখানায় বসে নতুন সংগঠনটি তৈরির পরিকল্পনা করেন এই তিনজন। পরিকল্পনা হয়, রক্সি ও শামিন জেলখানা থেকে বের হয়ে জঙ্গিদের নিয়ে শক্তিশালী একটি সংগঠন করবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী জামিনে বের হয়ে রক্সি ও শামিন কাজ শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তারা সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তার জন্য পাহাড়ি এলাকায় ক্যাম্পের সন্ধান শুরু করেন।

নতুন জঙ্গি সংগঠনের শামিন কুকিচিনের প্রধান দুজন বন্ধু : সিটিটিসি প্রধান আরও বলেন, চিকিৎসক শাকির, কৃষিবিদ মহসিন ও রক্সি জানান, শামিন মাহফুজ ২০০৬ সাল থেকে পাহাড়ি এলাকাকে কেন্দ্র করে একটি জঙ্গি নেটওয়ার্ক তৈরি করার জন্য পরিকল্পনা করে আসছিলেন। সবশেষ ২০১৭ সালে যখন তিনি জামিনে বের হন, তখন তিনি পাহাড়ি এলাকায় একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খুঁজতে থাকেন। এরপর তিনি জানতে পারেন যে, পাহাড়ি এলাকায় কুকি-চিন নামে একটি সংগঠন আছে। সেই সংগঠনের প্রধান হলেন নাথান বোম। নাথান বোম আবার শামিন মাহফুজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

শামিন মাহফুজ ও নাথান বোম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। এছাড়া শামিন একটি ক্যাডেটে কলেজের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। মেধাবী তালিকায় স্থান করে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করেন। নাথাং বোমের সঙ্গে যোগাযোগ করে শামিন তাকে তার সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রস্তাব দেন। নাথান বোম শামিনকে জানান, তারা অর্থের বিনিময়ে নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেবে। এই পরিকল্পনা হিসেবে ২০১৯ সালে কক্সবাজারের একটি হোটেলে মিলিত হন তারা। এই মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন শামিন, রক্সি, মসীন এবং বিকাশ ও তমাল নামে আরেকজন।

কুচিনের পক্ষ থেকে মিটিংয়ে ছিলেন নাথান বোম ও তার দুই সহযোগী। মিটিংয়ে অর্থের বিনিময়ে প্রশিক্ষণের সিদ্ধান্ত হলে নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায় প্রশিক্ষণ শিবিরে কাট আউট পদ্ধতিতে যাওয়া শুরু করেন। এছাড়া চিকিৎসক শাকির বিভিন্ন সময় এই প্রশিক্ষণ শিবির পরিদর্শন করেন।

সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে যতটুকু জানতে পেরেছি, পার্বত্য অঞ্চলকে প্রশিক্ষণ শিবির হিসেবে বেছে নেওয়ার অন্যতম কারণ হলো তাদের সদস্যদের নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা বজায় রাখা। পার্বত্য অঞ্চল থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে সমতল ভূমিতে এসে হামলা করে যেন নিরাপদে আবারও ক্যাম্পে ফিরে যেতে পারেন।

সংগঠনটির অর্থের উৎসের বিষয়ে সিটিটিসি প্রধান বলেন, আমরা সংগঠনটির মাস্টারমাইন্ড শামিন মাহফুজকে গ্রেফতার করতে পারলে এ বিষয়ে জানতে পারবো।

হিজরতের নামে নিখোঁজ আর ৭০ : সিটিটিসি প্রধান বলেন, আমাদের কাছে থাকা তথ্যমতে এখন পর্যন্ত ৭০ জন সদস্য নিখোঁজ রয়েছেন। হয়তো সবাই প্রশিক্ষণে যাননি। তিন ধাপে প্রশিক্ষণ শিবিরে লোক পাঠানো হয়েছে। তবে সবাই সেখানে যায়নি, অনেকে অন্য কোনো শেল্টার হোমে থাকতে পারেন।

জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্রিক হামলার পরিকল্পনা : আসন্ন জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্রিক নতুন জঙ্গি সংগঠনের কোনো পরিকল্পনা ছিল কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে সিটিটিসি প্রধান বলেন, হয়তো তাদের এমন পরিকল্পনা থাকতে পারে। তবে সংগঠনের প্রধানকে গ্রেফতার করা গেলে বিস্তারিত জানা যাবে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Visits Today: 3448
  • Total Visits: 722334
  • Total Visitors: 2
  • Total Countries: 1126

আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ সোমবার, ১৩ই মে, ২০২৪ ইং
  • ২৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (গ্রীষ্মকাল)
  • ৪ঠা জ্বিলকদ, ১৪৪৫ হিজরী
  • এখন সময়, রাত ২:০০

Archives

MonTueWedThuFriSatSun
  12345
13141516171819
20212223242526
2728293031  
       
  12345
2728     
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       

https://youtu.be/dhqhRb9y018